ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে সিলেট উচ্চ ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ বা ‘রেড জোন’ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখানে বড় মাত্রার অর্থাৎ ৬ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় সতর্ক হওয়ার পাশাপাশি ভবন জরিপ ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ভেঙে ফেলার তাগিদ দিয়েছেন তারা। পাশাপাশি ঝুঁকি মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি নেওয়ার কথাও বলেছেন।
ঝুঁকির প্রধান কারণ
সিলেটের অবস্থান মেঘালয় সীমান্তে অবস্থিত সক্রিয় ডাউকি ফল্ট লাইনের কাছে। এই লাইনটি অত্যন্ত সক্রিয় এবং ভূতাত্ত্বিকদের মতে, প্রায় ১৩০ বছর পর এটি নতুন করে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। ডাউকি ফল্ট ছাড়াও সিলেট ফল্ট এবং ত্রিপুরা ফল্টের অবস্থানও সিলেটের কাছাকাছি, যা এই অঞ্চলকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। এ ছাড়া এই অঞ্চলে অতীতে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ইতিহাস আছে। ১৮৯৭ সালের ‘বড় ভৈশাল’ নামে পরিচিত ৮.৩ মাত্রার একটি ভয়াবহ ভূমিকম্প ডাউকি ফল্টেই হয়েছিল।
অধিকাংশ ভবন বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি করা হয়নি
সিলেট নগরীর প্রায় অধিকাংশ ভবন বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি করা হয়নি এবং অনেক ভবনই পুরোনো ও দুর্বল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৬ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হলে এই ভবনগুলোর ৮০ শতাংশ ধসে পড়তে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জেলায় দফায় দফায় মৃদু ভূমিকম্প হয়েছে, যা স্থানীয় ফল্টগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দেয়। এই পরিস্থিতিকে বিশেষজ্ঞরা বড় ভূমিকম্পের আগাম সতর্কবার্তা হিসেবে দেখছেন। ঝুঁকি মোকাবিলায় সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) নগরীর ২৪টি ভবনকে ‘অতি ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং এগুলো ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ক্ষেত্রে এখনও ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ডাউকি ফল্ট লাইনে ভূ-কম্পন হলেই বিপজ্জনক
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) পুর ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মুশতাক আহমদ বলেন, ‘টেকটোনিক প্লেটের বাউন্ডারি সিলেটের কাছাকাছি থাকায় এ অঞ্চল ভূমিকম্পের সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছে। ডাউকি ফল্ট, সিলেট ফল্ট, ত্রিপুরা ফল্টের অবস্থান সিলেটের কাছাকাছি হওয়ায় ঝুঁকি অনেক বেশি। ডাউকির ভেতরে কিংবা বাইরে ভূ-কম্পন হলে সিলেটের জন্য তা হবে বিপজ্জনক।’
টেকটোনিক প্লেটকে কেন দায়ী করা হয়?
ভূমিকম্পের প্রধান কারণ হলো টেকটোনিক প্লেটের গতিবিধি। এগুলো পৃথিবীর ভূত্বকের বিশাল, অনমনীয় অংশ। যখন এগুলো একে-অপরের সঙ্গে ধাক্কা খায়, সরে যায় বা একে-অপরের নিচ দিয়ে চলে যায়, তখন ভূত্বকে কম্পন সৃষ্টি হয়। বেশিরভাগ ভূমিকম্প প্লেটের সীমানা বরাবর ঘটে। যখন দুটি প্লেট একে-অপরের পাশ দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, তখন অসম পৃষ্ঠগুলোর কারণে তাদের মধ্যে ঘর্ষণ হয়। শক্তি জমা হতে থাকে এবং হঠাৎ যখন এই বাধা দূর হয়, তখন কম্পন অনুভূত হয়। এগুলোর সঞ্চালনের ফলে সৃষ্ট চাপ ধীরে ধীরে শিলাস্তরে জমা হয়। যখন এই চাপ শিলাস্তরের ধারণক্ষমতাকে ছাড়িয়ে যায়, তখন শিলাস্তর ভেঙে যায় এবং সঞ্চিত শক্তি তরঙ্গ আকারে নির্গত হয়। এই তরঙ্গগুলোই মাটিকে কাঁপিয়ে তোলে।
ঝুঁকি মোকাবিলায় কতটা প্রস্তুত সিলেট?
ড. মুশতাক আহমদ বলেন, ‘আমার আশঙ্কা ডাউকি ফল্টে যেকোনো সময় বিপর্যয় ঘটতে পারে। কারণ মাধবদীর এক্সেনশন সিলেট পর্যন্ত বিস্তৃত। এ অঞ্চলের মানুষ আর যাই হোক বন্যা নিয়ে বেশি চিন্তা করে। কিন্তু ডাউকি ফল্ট যে আমাদের একেবারে কাছাকাছি তা নিয়ে একবারও চিন্তা করে না। শুধু ভূমিকম্প হলে কিছুদিন আলোচনা হয়। পরে আবার থেমে যায়। ভূমিকম্প সিলেটের জন্য একটি নিয়মিত আইটেম হওয়া উচিত। এজন্য একটি প্রেসার গ্রুপ তৈরি করতে হবে। যারা কিনা নতুন ভবনের ডিজাইন থেকে শুরু করে ভবন বানানোর পুরো বিষয়টি মনিটরিং করবে। ঝুঁকিতে থাকা সিলেটে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে নতুন ভবনের ডিজাইন থার্ড পার্টিকে দিয়ে ভেটিং করাতে হবে।’
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এরই মধ্যে ভেটিং পদ্ধতি চালু করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকায়ও অনুরূপ পদ্ধতি চালু করা প্রয়োজন। কুমিল্লা থেকে অনেক ভবনের অনুমোদনের কাগজপত্র শাবিপ্রবিতে পাঠানো হয়। অনুমোদনের সময় সিলেট সিটি করপোরেশনের হয়তো স্ট্রাকচারাল ডিজাইন চেক করার লোকের সংকট থাকতে পারে। থার্ড পার্টি দিয়ে ভেটিং করালে সিটি করপোরেশন ফি নির্ধারণ করে দিতে পারে। এজন্য বাড়তি অর্থ খরচ হবে না। বিপরীতে সংশ্লিষ্ট পার্টি একটি সার্টিফিকেট পাবে। নতুন ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের অবশ্যই কঠোর অবস্থানে যেতে হবে। পর্যাপ্ত খালি জায়গা না রেখে ভবন নির্মাণ করলে ভূমিকম্পে উদ্ধার কাজ চালানো যাবে না। এটি মানুষকে অবশ্যই বোঝাতে হবে।’
সিলেটে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে
শাবিপ্রবির সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম ঝুঁকি এড়াতে নগরীর সব বাসাবাড়ি নির্মাণে বিল্ডিং কোড অনুসরণের তাগিদ দেন। ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশনকে সতর্কতার ওপর
জোর দিতে হবে। ক্ষয়ক্ষতি রোধে নগরীর বিল্ডিংগুলোর কোডিং ডাটাবেজ তৈরি, ইভাকুয়েটিং ম্যাপিং, পর্যাপ্ত ভলান্টিয়ার তৈরি, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। ২০২১ সালে সিসিকের উদ্যোগে কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে দুটি ভাঙা হয়েছিল। বাকিগুলোর বিষয়ে কোনও আপডেট নেই। নতুন ভবনগুলো অনেকটা বিল্ডিং কোড অনুসরণ করেই নির্মিত হচ্ছে। তবে শঙ্কা আছে পুরাতন ভবন নিয়ে। এসব ভবন অনেক আগের তৈরি। এজন্য সিসিকের পাশাপাশি ভবন মালিকদেরও সতর্ক হতে হবে।’
কয়েক বছর আগে তুরস্কে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির বিষয় উল্লেখ ড. জহির বিন আলম বলেন, ‘সেখানে মান্ধাতার আমলের বেশিরভাগ ভবনের ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে।’
আটকে আছে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের জরিপ
থার্ড পার্টি দিয়ে ভেটিং করানোর বিষয়ে সিসিকের একজন প্রকৌশলীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-১৯৯৬ এবং বিএনবিসির রুলস-রেগুলেশনস মেনেই নগরীতে নতুন বিল্ডিং নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়। বর্তমানে সিসিকের তালিকাভুক্ত প্রকৌশলী ও ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির স্বাক্ষরে মূলত নতুন ভবন অনুমোদনের আবেদন করা হয়। আবেদনকৃত ভবনগুলো ভূমিকম্প প্রতিরোধক মর্মে সংশ্লিষ্টরা লিখে দেন। এরপরই ভবনের অনুমোদন দেওয়া হয়। সিসিকের জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে নগরীতে ২৭টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে। এর মধ্যে শাবিপ্রবির প্রকৌশলীরা নয়টি ভবনে প্রাথমিক সার্ভে (জরিপ) করে এগুলো উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পেয়েছেন।’
নয়টি ভবনই ব্যক্তিমালিকানাধীন জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘পূর্ণাঙ্গ সার্ভে চালানোর জন্য এসব ভবন মালিককে অর্থায়ন জোগানের তাগাদা দেওয়া হলেও তারা রাজি হননি। এ কারণে এটি আটকে আছে।’
জরিপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শাবির অধ্যাপক ড. মুশতাক আহমদ বলেন, ‘আমাদের মাধ্যমে মূলত কয়েকটি ভবনের প্রাথমিক সার্ভে হয়েছিল। এর মধ্যে কয়েকটিকে রেট্রোফিটিং (নির্মিত স্ট্রাকচারের ক্যাপাসিটি বাড়ানো) করতে হবে। প্রতিটি কম্পোনেন্ট ধরে ধরে এসব ভবনের ডিটেইলড অ্যাসেসম্যান্ট করতে হবে।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) মো. আলী আকবর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের একটি তালিকা আমাদের কাছে আছে। সেগুলো ভেঙে ফেলা হবে।’
ভেঙে ফেলা হবে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন
সবশেষ ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় নগরীর চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ সব ভবন ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গত সোমবার বিকালে নগর ভবনে অনুষ্ঠিত সিসিকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর আগে ২০১৯ সালে ২৪টি ভবনকে ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করে তালিকা তৈরি করেছিল সিসিক। প্রায় ছয় বছর পার হলেও তালিকায় থাকা চারটি ভবন অপসারণ এবং আরও দুটি ভবন বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পুনঃসংস্কার করা ছাড়া বাকি ১৮টি ভবনের বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
সভায় সিসিকের প্রশাসক ও সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী বলেন, ‘নগরবাসীকে নিরাপদ রাখতে ইতোমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত সব ভবন ভেঙে ফেলা হবে। আরও কোনও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন আছে কিনা, তা যাচাই করতে নতুন করে অ্যাসেসমেন্ট করা হবে। উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটির মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে সেগুলোকে ভাঙা হবে।’